হিতাহিত জ্ঞান হওয়ার পর থেকে এই কথাটা বুঝতে শিখেছি- ইন্ডিয়ার মত দেশ যদি অন্য কোন দেশের বন্ধু হিসেবে থাকে, তাদের আর শত্রুর প্রয়োজন নেই। সেই চরম সত্যটাকেই বিগত ষোল বছরের ফ্যাসিবাদী আওয়ামী বাকশালি শাসনের মাধ্যমে প্রাকটিকালভাবে দেখার সুযোগ পেয়েছি। এবার আসুন মোদ্দা কথায়:- ইন্ডিয়ার একপাশে ডানপন্থী পাকিস্তান। অন্যপাশে মধ্যপন্থী বাংলাদেশ। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যেভাবে শত্রুতা নিয়ে খেলা যায়, বাংলাদেশকে নিয়ে সেভাবে ধর্মযুদ্ধ খেলা যায় না। খেলা যায় না তার কারণ: যেহেতু বাংলাদেশ মজ্জাগতভাবে মধ্যপন্থী। তাছাড়া বিগত ষোল বছর সেভাবে খেলার দরকার ছিল না। দরকার ছিল না এজন্য; কারণ ষোল বছর বাংলাদেশ একটি স্যালুট স্টেট হিসেবে কাজ করেছিল। একজন খুনি রাক্ষসী রক্তপিপাসু শেখ দর্জি ছিল সেই স্যালুট স্টেটের পাহারাদার। খুনি ডাইনি শেখ দর্জি জনিত কর্মকাণ্ডের ফলে এদেশের মানুষ আরও প্রবল ভাবে ইন্ডিয়াবিরোধী হয়েছে। পলাতক শেখ দর্জির পতনের সাথে সাথে ইন্ডিয়ার সেই স্যালুট স্টেটের পতন ঘটেছে। জেগে উঠেছে আত্মসম্মানে বলিয়ান স্বাধীন সোনার বাংলাদেশ। ডঃ ইউনুস সরকারের হাতে বাংলাদেশ থেকে তারা স্যালুট স্টেটের মজা নিতে পারবে না। এটা তারা খুব ভালভাবেই জানে। আর বাংলাদেশে নির্বাচন হলে প্রবল সম্ভাবনা বিএনপি ক্ষমতায় চলে আসবে। এজন্য বিএনপির উপর ভর করে বাংলাদেশকে আবারও স্যালুট স্টেট কায়েম করার জন্য এখন তাদের প্রধাণ টার্গেট ডঃ মোহাম্মদ ইউনুসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে যেনতেন ভাবে অরাজক পরিস্থিতিতে ফেলে দ্রুত একটা নির্বাচন আদায় করে নেওয়া। কারণ ইউনুসের বৈশ্বিক গ্রহনযোগ্যতা ও কারিশম্যাটিক লিডারশীপের কারণে বাংলাদেশ যদি কিছুদিন স্বস্তিতে টিকে থাকতে পারে, আর রাষ্ট্র সংস্কারের মত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে পারে তাহলে চিরদিনের জন্য ইন্ডিয়ান হেজেমনিক বাংলাদেশ থেকে জয় বাংলা হয়ে যাবে। আর অতীত রেকর্ড বলে বিএনপি কোনদিনই বাংলাদেশের আত্মসম্মান বিকিয়ে দেয়নি। বিএনপি যতদিন ক্ষমতায় ছিল, ততদিন টাফ বার্গেনিং পয়েন্ট সচল ছিল। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়ার দেশপ্রেম নিয়ে কারো কোন প্রশ্ন নেই। তো সেই সূত্র ধরে ভবিষ্যতে বিএনপি দেশের অনুকূল পরিবেশে পূর্বের অবস্থান পাল্টাবে না; তা ইন্ডিয়া বুঝে। ইন্ডিয়া সেটা বুঝার কারণেই নতুন কলাকৌশল অবলম্বন আর লোভাতুর কিছু বামপন্থী সিনিয়র জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বকে হাতে নিয়ে বিএনপির ঘাড়ে সওয়ার হয়েছে, এবং তাদের মগজধোলাইয়ের কাজ ইতিমধ্যে অর্ধেকটা সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে বিএনপি কিছু বুদ্ধিজীবী নামের ইন্ডিয়ান ক্রীড়নকের ফাঁদে পড়ে তাদের পঁচা শামুকে পা কাটতে শুরু করেছে। সেই প্লানিং এর অংশ হিসেবেই বিএনপির কিছু সিনিয়র নেতারা এখন জামায়াত এবং অন্যান্য ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে কিছু না কিছু গালবাজি না করলে তাদের পেটের ভাত হজম হয় না। ভারত বিএনপির মাধ্যমেই তাদের কাল্পনিক সম্ভাব্য শত্রুকে পরাস্ত করার যেই মিশন নিয়ে নামছে, সে ক্ষেত্রে তারা এখন খানিকটা সফল হওয়ার পথে।বলতে গেলে এক্ষেত্রে অনেকটা সফল। এতো কিছুর পরেও জামায়াতে ইসলামীর কল্পনাতীত উত্থান এবং বিএনপির সাথে বিভিন্ন কারণে মনোমালিন্যতার মধ্যেও বৃহত্তর স্বার্থে ইদানিং রমজান কেন্দ্রিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃবৃন্দের একতা ভারতকে আবারও নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে। ইন্ডিয়ার হাতে এখন মূলত তিনটা অপশন আছে- একটা হলো বিএনপির কাঁধে ভর করে আবারও দাদাগিরি প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশকে একটি নতজানু স্যালুট স্টেট বানানো, এখন প্রশ্ন করতে পারেন, ইন্ডিয়া দ্বিতীয় অপশনে কি চাইতেছে বাংলাদেশে? দ্বিতীয় অপশনে ইন্ডিয়ার চাওয়া হচ্ছে আওয়ামী লীগকে আবারও সরকারে প্রতিষ্ঠা করা। তারা জানে এই প্রচেষ্টা আর সফল হবে না। সফল না হলে এখন কী করতে হবে? এটাতে সফল হবে না তা-ও মোটামুটি নিশ্চিত। এখন তাদের তৃতীয় অপশনটা হচ্ছে- পশ্চিমে যেমন পাকিস্তান আছে, পূর্বেও তেমন একটা পাকিস্তান লাগবে ইন্ডিয়ার। মানে, যে দেশকে উগ্রবাদী বলে প্রচার করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাজার পাওয়া যাবে। বাংলাদেশে ইদানীং যা ঘটতেছে তার উল্লেখযোগ্য পার্ট মূলত ইন্ডিয়ার পরিকল্পিত। তারা অনেক চেষ্টা করেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ডঃ মোহাম্মদ ইউনুসের বৈশ্বিক গ্রহনযোগ্যতার চমক এবং সচেতন ছাত্র- জনতার সুচতুর অবস্থানের কারণে সুবিধা করতে পারছে না। ইদানিং কয়েকবার দাঙ্গা পরিকল্পনা রুখে দিলো দেশের মানুষ। তবুও ইন্ডিয়া চেষ্টা করছে এবং করেই যাবে। সেই চেষ্টার অংশ হিসেবে মোদি, প্রিয়াঙ্কা, মমতা সবাই একসুরে গান গাইতেছে। আর তাদের গদি মিডিয়ার মলম বিক্রেতাগুলো নিয়মিত তিলকে তাল বানিয়ে প্রচার করেই যাচ্ছে। অন্যদিকে আমাদের দেশে কে বা কারা কী ঘটাচ্ছে তা-তো বলার অপেক্ষা রাখে না। ইন্ডিয়ার সরাসরি প্ররোচনায় বর্তমান সরকারকে একপ্রকার ধরাশায়ী অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল বিগত সাত মাসে ধারাবহিক কিছু আন্দোলন। প্রথমে ডাকাত লীগের তান্ডব, এরপরে উগ্রবাদীদের দ্বারা মাজার ভাঙ্গার মাধ্যমে সুন্নী লীগের আন্দোলন। এভাবে একের পর এক আনসার বাহিনী দিয়ে প্রতিবিপ্লবের ব্যর্থ চেষ্টা, সচিবালয়ের ক্যাডারদের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি করে প্রশাসনিক ক্যু ঘটানোর ব্যর্থ চেষ্টা, হাইকোর্টের বিচারপতিদের দিয়ে আইনী ক্যু ঘটিয়ে সরকার পতনের চেষ্টা। গার্মেন্টস শ্রমিকদের লেলিয়ে দিয়ে অরাজকতা তৈরির ব্যর্থ প্রচেষ্টা। রিকশা লীগকে মাঠে নামিয়ে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা। এরপরে হিন্দুত্ববাদী জঙ্গি ইসকনের উত্থানের মাধ্যমে সারাদেশে ব্যাপকহারে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে চট্টগ্রামে জামায়াতের আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে হত্যা। এগুলো সবকিছুই ধারাবাহিকভাবে ইন্ডিয়ান প্রেসক্রিপশনের ব্যর্থ প্রচেষ্টারই অংশ। ইন্ডিয়ার এই ধারাবাহিক অস্থিরতা তৈরির নাটকীয় কৌশলে আওয়ামী লীগের পাশাপাশি বিএনপির বামপন্থী সেকুলার গ্রুপ এবং ইসলামপন্থীদের একটি অংশ ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছে। এখন আমরা নিজেরাই বলি, বাংলাদেশকে হিন্দুস্থানের পূর্ব সীমান্তের পাকিস্তান বানাতে জ্ঞাতে / অজ্ঞাতে কী করতেছি অনেকে? সাম্প্রতিক নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হিজবুত তাহরীরের কথিত খেলাফত কায়েমের রঙিন খোয়াব নিয়ে আচমকা ঘোষণা দিয়ে মাঠে নামা, আর প্রশাসনের শক্ত হাতে দমন করাটা কিসের ইঙ্গিত বহন করে? তারা এতদিন এমন খেলাফত কায়েমের স্বপ্নে বিভোর ছিল, বিগত ষোল বছর একটা মিছিল কিংবা প্রেস কনফারেন্সও করারও সময় পায় নি। চব্বিশের ৫ই আগস্টের বিপ্লবের পরে দেশটা দীর্ঘ ষোল বছরের জঞ্জাল মুক্ত করে যখন একটু এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে, ঠিক সেই সময়ে এসে হাসিনার ক্ষমতা রক্ষার জন্য পশ্চিমাদের কাছে ফেরি করে বিক্রি করা মৌলবাদের বয়ানকে সরাসরি প্রাকটিকালভাবে প্রমাণের একটা নীল ষড়যন্ত্র নিয়ে এই হিজবুত তাহরীর মাঠে নেমেছে। নাহলে এই অস্থির সময়ে এসে তাদের মাঠে নামার কোন যৌক্তিকতা নেই। এরপর হঠাৎ করে গ্রামেগঞ্জে সংঘটিত ধর্ষনের মত বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনাকে কেন্দ্র ভারতীয় দাসচক্র শাহবাগীদের আস্ফালন সবাইকে ভাবিয়ে তোলার কথা। আলহামদুলিল্লাহ বাংলাদেশের সচেতন ছাত্রজনতার দেশপ্রেমের তীব্র জোয়ার এবং রুখে দেওয়ার অদম্য শক্তির কাছে শাহবাগের মরণযাত্রা এখন প্রায় সম্পন্ন হওয়ার পথে। এখন চলমান ছিনতাই চুরি ডাকাতি ধর্ষনের মত ঘটনাগুলো অধিকাংশ হচ্ছে পাতানো ষড়যন্ত্রের অংশ, আর কিছুটা বিচ্ছিন্নভাবে ঘটছে, যা স্বাভাবিক অবস্থায়ও ঘটে থাকে। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে- কোন এক অজানা কারণে দেশদ্রোহী উগ্র হিন্দুত্ববাদী পত্রিকা প্রথম আলো আর ডেইলি স্টারের মত ইন্ডিয়ান চরদের কাছে আমাদের বর্তমান সরকার নতজানু হয়ে গেছে। সরকারের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল গংরা তাদের ক্রীড়নকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। তারা এখন জুলাই বিপ্লবের পুরো ক্রেডিবিলিটিকে ছিনতাই করে প্লাস মাইনাসের গেইম খেলা শুরু করেছেন। জাতির এই অস্থির সময়ে বিভেদের চেয়ে বিবেককে প্রধান্য দেওয়া দরকার। ভাগাভাগির চেয়ে ঐক্যকে ধারণ করা দরকার। এখন আপনাকে আমাকে অবশ্যই ভাবতেই হবে- লোকাল রাজনীতির স্বাভাবিক ডেমোগ্রাফি চেঞ্জ করার উদগ্র বাসনা আদতে কি কারো সেবাদাস হবার জন্য? নাকি নিজস্ব স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে ধারণ করে স্বাতন্ত্র্যবোধ নিয়ে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাড়াবার জন্য? তাই যারাই প্রকৃতপক্ষে দেশ নিয়ে ভাবেন দয়া করে তারা এবার নিয়মতান্ত্রিকভাবে আসুন, দেশটাকে এবার গড়ে তোলার সময় এসেছে। উগ্রতা হীনমন্যতা আর প্রতিহিংসা পরিহার করে স্বচ্ছ মন নিয়ে জনগণের কাছে আসুন। যারাই ছোট-বড় প্রতিষ্ঠিত দল নিয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সরব আছেন কিংবা পর্দার আড়ালে থেকে অলিক কল্পনা করে রঙিন খোয়াব নিয়ে বসে আছেন, সকলেরই ভাবনার সময় এসেছে এখন। এই উপযুক্ত সময়ে আপনাদেরকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে পোস্টমর্ডার্নিজমের বয়ান, হেজিমনি, হেগেল, ইন্ধিরা গান্ধী আর বাকশালি মুজিবের মত এসব বড় বড় বোলচালের আড়ালে নব্য কলোনি বানানোর প্রকল্প রুখে দেবেন? আপনার আদরের মেয়েটাকে কি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কেরানী বানাবেন? নাকি চব্বিশের রক্তস্নাত গণঅভ্যুত্থানকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের মর্যাদা দিয়ে নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রেখে সব ভিনদেশী ষড়যন্ত্র রুখে দিয়ে হুজুগে পলিটিক্সের কবর রচিত করে আসলেই স্বাধীন থাকবেন, সেই সিদ্ধান্ত আপনাকে আমাকে একসাথেই নিতে হবে। ইনকিলাব জিন্দাবাদ বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।
Leave a Reply