বর্তমান প্রেক্ষাপটে উম্মাহ ধারণার ভিত্তিতে মুসলিম একতাবদ্ধতা আদর্শিক ভাবে প্রগাঢ় হলেও বাস্তবিক রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কাঠামোর কারণে তা অকার্যকর বলা চলে। এর মূল কারণ আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রকৃতি, যা সার্বভৌমত্বের ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় রাষ্ট্রই সকল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু, এবং তার স্বার্থই চূড়ান্ত বিবেচ্য।
রাষ্ট্রবাদ ও সার্বভৌমত্বকে বুঝলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে।রাষ্ট্রতন্ত্রের মূল নীতিই হলো সার্বভৌমত্ব। থমাস হোবস তার বিখ্যাত গ্রন্থ “Leviathan” এ বলেছেন যে মানুষের স্বাভাবিক অবস্থা হলো “নিয়মহীন, বিশৃঙ্খল ও সহিংস”, যেখানে প্রত্যেকে নিজের স্বার্থরক্ষার জন্য লড়াই করে। এই বিশৃঙ্খলা থেকে মুক্তি পেতে মানুষ একটি সামাজিক চুক্তি করে, যেখানে তারা তাদের কিছু স্বাধীনতা ছেড়ে দিয়ে একক সার্বভৌম এর অধীনস্থ হয়। হোবসের মতে, এই সার্বভৌম ক্ষমতা পরম, অবিভাজ্য এবং প্রশ্নাতীত। যেখানে সমস্ত আলাপ সালাপ রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ছাঁচে মাপা হয়। মানুষ কি চায় তার চেয়ে রাষ্ট্র কি চায় সেটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ রাষ্ট্র তার সার্বভৌমত্বের একক হকদার।
আধুনিক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক মূলত রাষ্ট্রকে চূড়ান্ত কর্তৃত্ব প্রদান করেছে সে কি চায় তা নির্ধারণ করতে এবং তার স্বার্থের ঊর্ধ্বে অন্য কোনো আদর্শ বা গোষ্ঠীগত পরিচয়কে রাষ্ট্র স্থান দেবে না এটাই স্বাভাবিক। এই কাঠামোতে প্রতিটি রাষ্ট্র তার নিজস্ব স্বার্থ রক্ষা করাই প্রধান লক্ষ্য হিসেবে দেখে, আর একারণেই উম্মাহর মতো বৃহৎ ধর্মীয় পরিচিতি কখনোই রাষ্ট্রীয় স্বার্থকে ছাপিয়ে যেতে পারে না।
এক কথায় বলতে গেলো মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের নীতি ও উম্মাহ কনসেপ্ট দ্বৈত অবস্থানে এখন। যতোই আবেগ দিয়ে বলি না কেন, কই মুসলিম শাসকরা, তারা কেন কিছু করছে না! তারা কিছু করবে না বা করার সুযোগ সীমিত। কেন? কেন উত্তরে বর্তমান মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর পররাষ্ট্র নীতিমালা বাধ্যতামূলকভাবে বিচার্য।
বর্তমান সময়ে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর অবস্থান বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায় যে, তারা উম্মাহ ভিত্তিক আদর্শের চেয়ে রাষ্ট্রীয় স্বার্থকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। দেওয়াটাই স্বাভাবিক। উদাহরণস্বরূপ, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটের ক্ষেত্রে দেখা যায়, বেশিরভাগ মুসলিম রাষ্ট্র মৌখিকভাবে ফিলিস্তিনের পক্ষে অবস্থান নিলেও, বাস্তবে তারা নিজেদের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক স্বার্থ বিবেচনা করেই নীতি গ্রহণ করছে। তুরস্ক একদিকে প্রকাশ্যে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে, কিন্তু অন্যদিকে তাদের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রেখে অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো রাষ্ট্রগুলো ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন জানালেও, ইসরায়েলের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করছে। ইরান নিজেকে মুসলিম বিশ্বের রক্ষাকর্তা হিসেবে তুলে ধরলেও, তার ভূ-রাজনৈতিক কৌশল মূলত শিয়া সম্প্রদায়ের প্রভাব বিস্তারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এটি প্রমাণ করে যে, উম্মাহর নামে একত্রিত হওয়ার চেয়ে রাষ্ট্রগুলোর জন্য তাদের স্বার্থরক্ষাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
আধুনিক আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাস্তবতা হলো রাজনৈতিক বাস্তববাদ (Realism), যা বলে যে, প্রতিটি রাষ্ট্রই মূলত তার নিজ স্বার্থ রক্ষার জন্য কাজ করে এবং আদর্শিক সংহতির চেয়ে বাস্তবিক শক্তির ভারসাম্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই মুসলিম বিশ্বের জন্য উম্মাহ ভিত্তিক একতা গড়ে তোলা প্রায় অসম্ভব, কারণ প্রতিটি রাষ্ট্রই তার ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক অবস্থান বিবেচনা করেই কূটনীতি পরিচালনা করে। উদাহরণস্বরূপ, ওআইসি (Organisation of Islamic Cooperation) মুসলিম বিশ্বের বৃহত্তম সংগঠন হলেও, এটি কার্যত খুব কমই মুসলিম সংহতি রক্ষায় সফল হয়েছে। কারণ প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রের নিজস্ব কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে, যা উম্মাহ ভিত্তিক সংহতির পথে বড় বাধা।
পরিশেষে, বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় উম্মাহ ধারণার ভিত্তিতে মুসলিম বিশ্বকে একত্রিত করা কার্যত অসম্ভব। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সার্বভৌমত্বের ধারণা এমনভাবে গড়ে উঠেছে যে, প্রতিটি রাষ্ট্রের নিজস্ব স্বার্থই তার নীতিনির্ধারণের প্রধান ভিত্তি। ধর্মীয় সংহতি রাজনৈতিক ও আদর্শিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলেও, বাস্তব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থের কাছে তা গৌণ হয়ে পড়ে। ফলে, উম্মাহ ভিত্তিক সংহতির ধারণাটি আদর্শিকভাবে শক্তিশালী হলেও, আধুনিক রাষ্ট্রকেন্দ্রিক বাস্তবতায় এটি কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
লেখক-
তৌহিদুল ইসলাম
লেকচারার-আইন বিভাগ
বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
Leave a Reply