একটি দেশ কতটা সভ্য সে বিচারটি দেশের ভূ-প্রকৃতি, জলবায়ু,গাছপালা, ক্ষেত-খামার দিয়ে নির্ণয় হয় না। ইট-পাথরও লোহালক্কড় দিয়ে নির্মিত ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট বা কলকারখানার সংখ্যা দিয়ে হয় না। বরং রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ভাষায় সে বিচারটি হয়- সে দেশের মানুষের জীবনের মান,শাসকের মান,শাসনের মান, এবং আদালতে আইনের মান দিয়ে। চলার স্বাধীনতা, বলার স্বাধীনতা, লেখার স্বাধীনতা, ভোট বা রায় প্রদানের সুযোগ, মুক্ত বাতাসে মানুষের মৌলিক ও সার্বিক জীবনাচারণের গতি দিয়ে নির্ণয় করা হয় একটি দেশের ভাল-মন্দ অবস্থান। ফেরাউন নমরুদ হালাকু খান-চে’ঙ্গিস খান, শেখ মুজিব আর শেখ হাসিনার মত খুনি চোর ডাকাতের হাতে কোন দেশ বা জনপদের গদির ভার গেলে সেখানে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাটও প্রাসাদ মোটেও নির্মিত হয় না তা নয়, বরং আরো ভিন্ন আঙ্গিকে অতিমাত্রায় অতিরঞ্জিত উন্নয়নের ধারা দিয়ে ভাসিয়ে দেয়া হয় দেশকে । কিন্তু উন্নয়নের আড়ালে জন্ম গ্রহণ করে মানবরুপী এক অসভ্য দানবীয় প্রথা।
ঝাঁক ঝমকও চাকচিক্যময় স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন, পূর্বসূরি নেতা বা বাপ-দাদা আর স্বামীর প্রতিকৃতি বা ভাস্কর্য নামের পূজনীয় মূর্তি নির্মাণ করে চমক দেখালেই কেবল তাকে উন্নত দেশ বা রাষ্ট্র বলা যায়না। সবখানেই দলের নেতা নেত্রীকে হাইলাইট করে রাষ্ট্রের সবকিছুকেই তাদের দয়াদাক্ষিণ্য নির্ভর বানিয়ে জনগণের উপর পরিবারতন্ত্র চাপিয়ে দিয়ে মানুষকে গণতন্ত্রের ছবক পড়ানোটা কোন সভ্য রাষ্ট্রের পরিচয় নয়। আর উন্নয়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া, সেটা কোন ব্যক্তি বা দল বিশেষের কারিশমা নয়। যুগের চাহিদার উপর ভিত্তি করে উন্নয়ন সাধিত হয়। আদিম যুগ থেকে এটাই নিরেট সত্য। উন্নয়ন আর গণতন্ত্রের ডুগডুগি বাজালেই কোন দেশ বা জনপদ খুব ভাল আছে বলে ধরে নেওয়া যায় না এবং ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের গদিতে আরোহন করার জন্য রাষ্ট্রের মৌলিক চাহিদাকে গুরুত্ব না দিয়ে কেবল গণতান্ত্রিক শাসন আর উন্নয়ন সাধনের প্রতিশ্রুতির মধ্যেও রাষ্ট্রের কোন কল্যাণ নিহিত নাই। বরং এটা একপ্রকার বাটপারিও ভন্ডামি ছাড়া কিছু নয়। এরুপ কথামালার প্রতিশ্রুতি আর উন্নয়নের ডুগডুগি প্রাচীন মিশরের বনু আমালেকা বংশের স্বৈরাচারী শাসক ‘ওলিদ ইবনে মুসআব ইবনে রাইয়ান’ যাকে পবিত্র কোরআনে জালিম ফেরাউন নামে চিহ্নিত করে দেওয়া হয়েছে, সেই ফেরাউনও বাজাতে অভ্যস্ত ছিল। তবে ফেরাউন সরকারের এসব কৃত্রিম উন্নয়ন, গালগল্পও রাষ্ট্রীয় প্রচারকে গুরুত্ব দিয়ে উন্নয়নের মূল্যায়ন করে আজ পর্যন্ত বিশ্বের ইতিহাসে কোন চিন্তাবিদ তৎকালীন মিশরের ভৌগোলিক অবস্থানের সার্বিক ব্যবস্থা তথা তৎকালীন মিশরীয় জনগণের জীবনযাত্রার মান খুব একটা ভাল ছিল বলে স্বীকৃতি দেয়নি। আর দেওয়া সম্ভবও নয়। এবার আসুন আসল কথায় – ইসলাম তার প্রাথমিককালে পৃথিবীতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা জন্ম দিয়েছিল এক মহা জীবনবিধাণের গাইডলাইন অনুযায়ী। সেই মানবীয় গুনাবলি সম্পন্ন সভ্যতা গড়ে তোলার পিছনে কোন স্বঘোষিত জাতির পিতা আর স্বাধীনতার ঘোষকের কারিশমা ছিল না। কোন তাজমহল, পিরামিড, চোখধাঁধানো টাওয়ার, শত মাইলের দৈর্ঘ সেতু, উচু উচু ফ্লাইওভার, মেট্রোরেলে-টানেল বা রাষ্ট্র সংষ্কারের প্রণোদনা মূলক প্যাকেজের ভূমিকা ছিলোনা। এসব ইশতেহার ঘোষণা না দিয়েই, কোনরূপ বিস্ময়কর শৈলী না গড়েই ইসলাম পৃথিবীতে ব্যাপক এক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। তবে সে যুগের চাহিদার উপর ভিত্তি করে সব কিছুই গডে উঠেছিল যা ছিল বাস্তবতার আলোকে জনজীবনের বাস্তব চাহিদাও প্রকৃতি নির্ভর, আজকের মত মহা বাটপারিতে পারদর্শী কৃত্রিমতায় ভরপুর সাইনবোর্ড সর্বস্ব রং লাগানো নামকাওয়াস্তে উন্নয়ন ছিল না। জনগণের ট্যাক্সের বিনিময়ে সাধিত উন্নয়নকে বিশেষ কোন ব্যক্তি- পরিবার বা দলের দয়া আর দান বলে প্রচার করা হতো না। ইসলামের গড়ে তোলা সেই সভ্যতা জন্ম দিয়েছিল এমন বিবেকবান শাসক গোষ্ঠীর, যারা চাকরকে উটের পিঠে চড়িয়ে নিজে উটের রশি ধরে সামনে চলাকে নিজের নৈতিক দায়িত্ব মনে করতো। সেই সভ্যতার ধাঁচে গড়ে ওঠা শাসকেরা স্রষ্টা প্রদত্ত বিধানের আলোকে প্রতিষ্ঠা করেছিল এমন উন্নত আইনের যে আইনের স্রষ্টা কোন মানুষ বা কোন পার্লামেন্ট ছিলোনা, ছিলেন খোদ মহান আল্লাহ তায়ালা। সেই শরিয়তি আইনে নারী-পুরুষ তার মৌলিক স্বাধীনতাও ন্যায্য অধিকার পেয়েছিল। বিলুপ্ত হয়েছিল আদি আমল থেকে চলে আসা দাস’প্রথা। নারীও শিশুরা সেদিন জীবন্ত দাফন হওয়া থেকে বেঁচেছিল। সমাজ থেকে বিলুপ্ত হয়েছিল ম’দ্যপান, জু’য়াও ব্য’ভিচারের ন্যায় আদিম অপরাধ। নানা ধর্মের মানুষ সে সমাজে নিরাপদে বাস করার সুযোগ পেয়েছিল। সে রাষ্ট্রে কোন কালেই কোন সা’ম্প্রদায়িক দা’ঙ্গা ঘটেনি। ধর্ষণের মত অপরাধ করে কেউ পার পেয়ে যায় নি। অথচ আজ আমরা এতো জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি আর উন্নত মানব সভ্যতার দাবিদার! কিন্তু আজকের সমাজ, আজকের সভ্যতা, আজকের রাষ্ট্র, আজকের পৃথিবী, আজকের শাসিত জনগন,আজকের প্রতিটি জনপদ ফেরাউন- নমরুদ, হালাকু-চে’ঙ্গিসের ন্যায় বর্বর চোর ডা’কাত আর খু’নিদের হাতে অধিকৃত। এদের হাতে লুট হচ্ছে মানব সভ্যতার মানবিক মৌলিক সকল অধিকার। এরা হাত দিচ্ছে মানুষের ইজ্জত আবরু ও জান মালের উপর। সাধারণ নিরীহ মানুষ আজ পথেঘাটে লাশ হচ্ছে। মৌলিক অধিকার, বাকস্বাধীনতাও মৌলিক গণতন্ত্র আজ আস্তাকুঁড়ে গিয়ে পড়েছে। আজকের বিশ্ব মোড়লের তথাকথিত গনতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতি ইসলামপূর্ব স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট যুগ আইয়ামে জাহেলিয়াতকেও হার মানিয়েছে। বরং তার চেয়েও ভয়ংকর রুপ ধারণ করেছে। মানুষ আজ মানব রচিত কল্পনাপ্রসুত আদর্শ দিয়ে শান্তির হরিণ খুঁজছে। আজ প্রত্যেকেই মনগড়া চেতনার লালন আর আত্মম্ভরিতার নেশায় আসক্ত হয়ে এই যুগের তথাকথিত মহারতি আত্মপূজারী নেতাদের বন্ধনায় ব্যস্ত। এই অসুস্থ সমাজ-সভ্যতা, রাষ্ট্র ও বিশ্ব ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য বিপুল সংখ্যক নয়, স্বল্পসংখ্যক মানুষ ই যথেষ্ট। যারা নির্ণয় করতে সক্ষম হবে, আজকের মানবতা বিধ্বংসী মরণব্যাধি রোগের প্রতিষেধক। বস্তুতঃ এমন এক অসুস্থ ধারা থেকে উত্তরণের জন্য সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ মহামানব বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর আগমন ঘটেছিল। যারা পৃথিবীতে শান্তির সুবাতাস বয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল, তারা সেই মহামানবের কালজয়ী আদর্শ ধারণ করেই সফলতা লাভ করেছিল। পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত তার আদর্শ ছাড়া কাঙ্খিত শান্তি ও মুক্তির নাগাল কেউ পায়নি, দিতে পারেনি মানুষের মৌলিক কোন অধিকার। তাই আজকের ব্যক্তি গঠন, পরিবার গঠন, সমাজ গঠন, সভ্যতার নির্ণয়, রাষ্ট্র গঠনও পরিচালনা, বিধস্ত পৃথিবীকে উদ্ধার করতে হলে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সেরা জীবন ব্যবস্থা ইসলামের নির্দেশিত নীতিমালাও বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর প্রদর্শিত পথের অনুসরণের বিকল্প কোন চিন্তা করাও ভুল হবে। সুতরাং আসুন- সেই প্রেরণা আর চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে একটি বসবাসযোগ্য পৃথিবী আর স্বস্তিময় সভ্যতা গড়ে তুলতে হলে আগে প্রতিটি ব্যক্তিকে আত্মশুদ্ধিতে অভ্যস্ত হয়ে আত্মসমালোচনা কে চর্চা করা প্রয়োজন। এবং সময়ও যুগের চাহিদার আলোকে বাস্তবতাকে উপলব্ধি করে জ্ঞান-বিজ্ঞান তথা প্রযুক্তির জগতে নিজেদের কে আরো ধাবিত করা প্রয়োজন। আধ্যাত্মিকতার চর্চা করার প্রয়োজনীয়তা খুবই, তবে আধ্যাত্মিকতা হউক কেবল মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে, কোন লোকদেখানো ছদ্মবেশ ধারণ বা পোশাকআশাক কেন্দ্রিক বুজুর্গী নয়। যুগ জামানার কৃষ্টি-সংস্কৃতি আর জনজীবনের গতিবিধির বিচার-বিশ্লেষণ করেই আধ্যাত্মিকতাও বাস্তবতা কে ইসলামী শরীয়তের নির্দিষ্ট গন্ডির ভিতরে থেকে কোরআনে উল্লিখিত গাইডলাইনের আলোকে সমম্বয় করতে হবে। তবে যুগের ধ্যান-ধারণার সাথে সমম্বয় করতে গিয়ে নিজের ধর্মীয় জাতিসত্তার স্বাতন্ত্র্য অসাধারণত্ব যেন বজায় থাকে। এতেই প্রতিটি পরিবার-জনপদ,রাষ্ট্র তথা পুরো পৃথিবীকে বসবাসযোগ্য করে গড়ে তোলার সম্ভব। মহান প্রভু আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে কবুল করুন। আমীন।
Leave a Reply